বাংলাদেশ জার্নাল অব পলিটিক্যাল ইকোনমি
খণ্ড ১, সংখ্যা ১, ডিসেম্বর ২০২১
সম্পাদকীয়
মানুষের যাপিত জীবনে কর্মে ও মননে বোধোদয়নের প্রথম পাঠ হওয়া উচিত নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ হওয়া। কিন্তু পরিতাপের বিষয়— দুর্বৃত্ত অর্থ ও পুঁজির দৌরাত্ম্যে জর্জরিত ‘রাষ্ট্র-সমাজ-অর্থনীতি’ ব্যবস্থায় ব্যক্তির চারপাশ থেকেই সু-নীতি বিলীন হয়েছে। পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে কু-নীতিনির্ভর সর্বগ্রাসী স্বার্থপরতা। লোভ-লালসার কালোছায়া এখন বিবেকের আঙিনায় সদর্পে বিচরণ করে। সর্বব্যাপ্ত অন্যায়-অনাচারে সুবিচারের আশা এখন ক্ষীণ। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ‘কভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস’ নামক এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসও বৈশ্বিক মহামারির সৃষ্টি করে আমাদের অস্তিত্ব নিয়েই টানাহ্যাঁচড়া শুরু করেছে। আমাদের জীবনকে গাঢ় অনিশ্চতায় নিক্ষেপে করেছে। তাই তো সবারই ব্যাগ্র জিজ্ঞাসা—এ অবস্থা থেকে মুক্তির পথ কী? পথ নিশ্চিতভাবেই আছে। এবং তা আছে আমাদের হাতেই। কারণ, সৃষ্টিজগতে আমরা ‘মানুষ’ই শুধু ঘোর অমানিশা ভেদ করে আলোকিত পথ রচনা করতে পারি। জটিল ও কঠিন এই বাস্তবতায় মুক্তির পথ অন্বেষণে এবং সঠিক নির্দেশনার মানসে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এই-ই প্রথম বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হলো ‘বাংলাদেশ জার্নাল অব পলিটিক্যাল ইকোনমি’।
আমাদের এই উদ্যোগটি বিশেষ এক তাৎপর্য বহন করে এই জন্য যে, শুধু প্রতিথযশা অর্থনীতিবিদ-সমাজচিন্তক ও বরেণ্য গবেষকেরাই নন, তরুণ ও মেধাবী অর্থনীতিবিদ ও গবেষকসহ বিভিন্ন পেশাজীবীর লেখায় সমৃদ্ধ এই সংখ্যাটি। কৃতী এই মানুষদের কেউ কেউ জাতির কাছে পরম শ্রদ্ধার পাত্র। সমাজবিজ্ঞানের নানা শাখা-স্তরে স্বচ্ছন্দ বিচরণ তাঁদের। নীতি-নৈতিকতা নিয়ে তাঁরা অহর্নিশ ভাবেন। ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রকে পরিশুদ্ধ করে মানুষের জীবনকে শোভন ও আলোকিত করাই এই মানুষদের ধ্যান-জ্ঞান। স্বভাবতই তাঁদের লেখনিতে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের প্রকাশ রয়েছে, রয়েছে অনাগত কোনো শঙ্কার কথা অথবা নির্মোহ প্রত্যাশা। এবং এর সবই প্রকাশ পেয়েছে ‘কভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাস’-এর মহাবিপর্যয়ের ঠিক অব্যবহিত আগে আগেই অর্থাৎ ২০১৯-২০ সময়কালে। কারও কারও লেখায় মানবসমাজের বর্তমান মহাবিপর্যয়কর এই অবস্থার প্রচ্ছন্ন আভাসও পাওয়া যায়। ধীমান এই লেখকেরা নিজেদের গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আপন সময়কে ধরে রেখে নৈতিকতাকে বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন অনুপুঙ্খ। এবং সে কারণে তাঁদের কাছ থেকে ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রের এই যুগসন্ধিক্ষণে পথনির্দেশনা পাওয়া যে খুবই সম্ভব—সে কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
এই জার্নাল নানা মাত্রিকতায় সাবলীল লেখনিসমৃদ্ধ সু-নীতি ও কু-নীতির বিশেষ এক পরিক্রমা। নানান প্রসঙ্গে, বিষয় থেকে বিষয়ান্তরের মননদীপ্ত প্রকাশভঙ্গি এবং লেখনির বিপুল বৈচিত্র্য ও উদ্ভাস আমাদের আশাম্বিত করে। তাঁদের অজ¯্র আপন ভাবনার প্রকাশ—আমাদের মন-মননকে শোভন করবে; সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্রকে করণীয় বাতলে দেবে—সর্বোপরি মানুষের বিবেককে গ্রহণ-বর্জনের যৌক্তিক বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দেবে। অর্থনীতিশাস্ত্র সামাজিক বিজ্ঞানের শুধু অন্যতম শাখাই নয়; এর শেকড় দর্শন ও নীতিশাস্ত্রের অনেক গভীরে প্রোথিত, সুবিন্যস্ত। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে অর্থনীতিশাস্ত্রের চর্চায় নীতিনৈতিকতা এখন কতটুকু বিদ্যমান—সে নিয়ে সাধারণমনের সকরুণ জিজ্ঞাসা আমাদের ভাবিত করে, অনেক ক্ষেত্রে দুঃশ্চিন্তিত এবং ব্যথিতও করে। সে কারণে অর্থশাস্ত্রঘনিষ্ঠ মানুষ হিসেবে লেখকদের গভীর উপলব্ধির প্রতিফলনসমৃদ্ধ এই জার্নাল কাল-পর্বের বিস্তৃত এক আলেখ্য, যা আমাদের চিন্তার খোড়াক দেবে—বিবেক চেতনায়নে তাড়িত করবে।
এই জার্নালে স্থান পাওয়া লেখাগুলোর সবই অভ্রান্ত-অকাট্য, তেমনটি বলা যুক্তিসঙ্গত হবে না। জ্ঞানার্জনের পথ সরলরৈখিক নয়, মসৃণ তো নয়-ই—জ্ঞানের পথ চলায় তাই তর্ক-বিতর্ক থাকাই স্বাভাবিক। তবে কিছু প্রবন্ধের মর্মবাণী অগণন হরফের ভিড়ে কখনোই হারিয়ে যাওয়ার নয়, এর মূল্য চিরকালীন-সর্বজনীন। কারণ—প্রবন্ধে অনুষঙ্গ হিসেবে এসেছে একবিংশ শতকের বৈশি^ক জীবনে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন, নব্য-ফ্যাসিস্ট আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ, বর্বর পুঁজিবাদ, তথাকথিত নব্য উদারবাদ, রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্র, ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, যুদ্ধ, সভ্যতার সংকট; জাতীয়জীবনে আমাদের স্বদেশভ‚মি বাংলাদেশের সৃষ্টি ও ছন্দপতন, বাঙালি জাতির পিতার হত্যা ও অসময়ে তিরোধানে আমাদের অন্ধকারযাত্রার উৎসের সন্ধান এবং তা থেকে উত্তরণের পথনির্দেশনা; আছে মৌলবাদ, শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ, গ্রাম-শহরনির্বিশেষে মানুষের নিদারুণ ক্লেশের অনুসন্ধান ও তা থেকে মুক্তির আকাক্সক্ষা; আছে আমাদের স্বাস্থ্য, খাদ্যনিরাপত্তা, আর্থসামাজিক উন্নয়নসহ নানা বিষয়ের গভীর বিশ্লেষণ। এসব প্রবন্ধ পাঠ শেষে যে-কেউই নির্দ্বিধায় স্বীকার করবেন—প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ জীব দাবিকারী হিসেবে নৈতিকতা-মনুষ্যত্ববোধ ফিরিয়ে আনাই এখন সবচেয়ে জরুরি। আর এই উপলব্ধিবোধই কেবল আমাদের সঠিক পথ দেখাতে সক্ষম।
বাংলা ভাষায় লেখা নির্মোহ ও নিরেট তত্ত¡ ও তথ্যের আকর এই জার্নালের আলোকোজ্জ্বল লেখাগুলোর জন্য লেখকদের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। মানবসমাজের শোভন জীবনের আকুতি নিয়ে একঝাঁক জ্ঞানীর এই প্রবন্ধসমগ্রের পাতায় পাতায় ফুটে ওঠা—মানুষের প্রতি ভালোবাসা—আমাদের গর্বিত করেছে। সম্পাদনা উপদেষ্টা কমিটির সম্মানিত সদস্যবৃন্দ, কার্যনির্বাহক কমিটি, সমিতির সম্মানিত সদস্য এবং শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি রইল শ্রদ্ধা। এই সংখ্যায় গ্রন্থিত প্রবন্ধসমূহ যথারীতি পর্যালোচিত এবং সম্পাদকীয় পর্ষদের অনুমতিসাপেক্ষে প্রকাশ করা হলো। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া আমাদের বর্তমান বাস্তবতা পেছনে ফেলে বৈষম্যহীন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসমৃদ্ধ ‘সোনার বাংলাদেশ’ গড়ার পথ রচনার স্মারক এই জার্নাল বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ঐশ্বর্য্য ও গর্ব।
আবুল বারকাত
সম্পাদক, বাংলাদেশ জার্নাল অব পলিটিক্যাল ইকোনমি
সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, ঢাকা।